লেখক বলেছেন অনেক

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা, গ্যালিলিয়-লরেন্টজ রূপান্তর

আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, গ্যালিলিয় ও লরেন্টজ রপান্তর
তুমি আর তোমার বন্ধু, দুজনেরই বয়স ১৬ বছর। যদি এক বছর পার হয় তাহলে তোমাদের বয়স কত হবে? ১৭ বছর? হ্যাঁ, অবশ্যই। তবে বন্ধুরা, এমন কী হতে পারে তোমার বয়স হবে ১৮ বছর আর তোমার বন্ধুর ১৭ বছর? হতে পারে। বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? বা হলেও অনেক খটকা লাগছে, কিভাবে সম্ভব? আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকেই আমরা এটা প্রমাণ করতে পারি। তাহলে এই আপেক্ষিকতা তত্ত্বটা কী? আপেক্ষিক তত্ত্ব আলোচনা করতে আমাদের আগে আপেক্ষিক জিনিসটা কী আর প্রসঙ্গ কাঠামো সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া লাগবে।
ধরো, তুমি A বিন্দুতে আছো। A আর B বিন্দুর দূরত্ব 5 মিটার। তারপর সামনে 5 মিটার দূরে C বিন্দুতে গেলা। তাহলে A বিন্দু থেকে তুমি 5 মিটার দূরে। বা, A বিন্দু ‘সাপেক্ষে’ 5 মিটার দূরে। তবে, B বিন্দু সাপেক্ষে 10 মিটার দূরে। এরকম ভিন্ন ভিন্ন বিন্দু সাপেক্ষে তোমার দূরত্ব ভিন্ন। এই যে দেখছো, তোমার অবস্থান বা দূরত্ব একটা ‘বিন্দু’র সাপেক্ষে বিবেচ্য। এটাই আসলে আপেক্ষিকতা। তোমার বেগ 5 m/s, কোনো বিন্দুর সাপেক্ষে। তোমার অবস্থান 10 মিটার, কোনো বিন্দুর সাপেক্ষে।
তাই এটা স্পষ্ট যে, কোনো একটা স্থানে বা নির্দিষ্ট পরিসরে কোনো কিছুর অবস্থান প্রকাশ করতে একটা মূলবিন্দু প্রয়োজন। এরকম একটা পরিসরকে প্রসঙ্গ কাঠামো আর মূলবিন্দুকে প্রসঙ্গ কাঠামোর মূলবিন্দু বলে। মানে, যেকোনো স্থানকেই প্রসঙ্গ কাঠামো বলা যায়, তবে দূরত্ব, বেগ এসব মাপার জন্য একটা মূলবিন্দুও ধরে নিতে হয়। এখন এগুলো কিভাবে প্রয়োগ করবো?
প্রয়োগ আসবে গ্যালিলিয়ান রূপান্তরে। প্রথমে খুব সংক্ষেপে বুঝাই, পরে আসলটা বোঝাবো। তাই আমাদের আশেপাশের জগতে চোখের সামনে যেটা সহজে দেখতে পাই সেটায় আসি। ধরো, তুমি গাড়ি করে বাসা থেকে রওনা হলে, বাসা সাপেক্ষে তুমি গতিশীল। গাড়ির বেগ যাই হোক না কেন, গাড়ির মধ্যে তুমি, গাড়ি সাপেক্ষে তুমি স্থির। তাহলে এই উদাহরণটা বিজ্ঞানী গ্যালিলিও এর দৃষ্টিতে গাণিতিকভাবে দেখি।
তোমার বাসা একটা প্রসঙ্গ কাঠামো যার মূলবিন্দু ধরো S’। এবার, ধরো তোমার গাড়ির মূলবিন্দু S। জটিল গাণিতিক হিসাব না করে ধরলাম গাড়ি কেবল x অক্ষ বরাবর গতিশীল।
এখন ধরলাম, S কাঠামো সাপেক্ষে গাড়িতে তোমার অবস্থান x, y, z, t.
S’ কাঠামো সাপেক্ষে গাড়িতে তোমার অবস্থান x’, y’, z’, t’.
তাহলে, তোমার গাড়ি যদি v সমবেগে গতিশীল হয়, তাহলে
x’ = ( x -vt)
y’ = y
z’ = y
t’ = t
আমরা যে এই জিনিসটা আলোচনা করলাম এটাই গ্যালিলীয় রূপান্তর। এখন রূপান্তর আবার কী? আসছি, তবে এখানে কয়েকটা জিনিস খেয়াল করো।
প্রথমত, আমি সমবেগে গতিশীল চিন্তা করেছি। কারণ, সমবেগের উপর ভিত্তি করে আমরা আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব আর লরেন্টজ রূপান্তর দেখবো – কারণ ত্বরণে হিসাবটা অনেক বেশি জটিল আর বোঝতে অনেক উচ্চতর গণিত প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, কেবল x অক্ষ বরাবর গতিশীল ধরেছি, এটা হিসাবের সুবিধার জন্যে। এটার উপর ভিত্তি করেই আমরা লরেণ্টজ রূপান্তর দেখবো, তাই হিসাব টা সহজ করে দেখেছি।
তৃতীয়ত, উভয় প্রসঙ্গ কাঠামোতে সময় একই, এটাই কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা।
গ্যালিলিয়ান এই রূপান্তরটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আবার, তোমরা নিশ্চই গতি অধ্যায়ে আপেক্ষিক বেগের অংক করেছিলে, এটাও কিন্তু গ্যালিলিয়ান রূপান্তরে পরে। অপেক্ষাকৃত বড় বস্তু (বড় মানে কেবল আইফেল টাওয়ার সাইজের না আবার, মিলিমিটার লেভেলের বলতে পারো, খালি পারমাণবিক লেভেলের না আর কি) যার বেগ আলোর কাছাকাছি কখনো যায় না, তাদের জন্য এই গ্যালিলিয়ান রূপান্তরে কোনো ত্রুটি নেই। সমস্যা দেখা যায় পারমাণবিক স্কেলে আর আলোর তুল্য বেগ নিয়ে কাজ করতে। কী সেই সমস্যা? চল বন্ধুরা, আমাদের এবার সময় হয়েছে গ্যালিলিয়ান রূপান্তরের ভুলগুলো আলোচনা করার। আর তা থেকে কিভাবে আইন্সটাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের জন্ম হয়েছে, সেটাও দেখবো।
সালটা ১৮৮৭। মাইকেলসন আর মর্লি আবিষ্কার করলেন ইথার বলে কিছুই নেই। আলোর বেগ শুন্য মাধ্যমে কনস্ট্যান্ট। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তখনও মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। কারণ তাদের ফলাফল অনুযায়ী গ্যালিলিয়ান রূপান্তর ভুল। ভুলটা ধরতে পারো কী, কোথায় করেছি? চলো, আমরা আমাদের S কাঠামোতে আলোর বেগ c পরিমাপ করি। তাহলে S’ কাঠামো অনুযায়ী পর্যবেক্ষকের বেগ আসবে c-v, আবার, S’ কাঠামোতে বেগ c পরিমাপ করলে S কাঠামোতে আসবে c+v। মাইকেলসন মর্লি পরীক্ষায় এমন হিসেব কিন্তু আমরা করেছিলাম। উভয় ক্ষেত্রে যদি পরিমাপ করা বেগ c আসতো, তাহলে কিন্তু রেজাল্টের সাথে একেবারে মিলে যায়। আবার, তড়িৎচুম্বক তত্ত্বের সমীকরণগুলোর সাথে গ্যালিলিয়ান রূপান্তর সঙ্গতিপূর্ণ ছিলোনা। আইন্সটাইন দেখলেন যে, যদি তিনি বেগ c ধ্রুব ধরে হিসাব করেন, তাহলে এই সমস্যার সমাধান হয়। অবশেষে ১৯০৫ সালে আইন্সটাইন তার স্পেশাল আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দ্বার করান, যেটা সরাসরি মাইকেলসন মর্লির পরীক্ষার ফলাফল থেকে পাওয়া। মাইকেলসন মর্লি দেখলেন যে, ইথার বলে কিছুই নেই। আরো বুঝলেন যে, যেহেতু গ্যালিলিয়ান রূপান্তর বিবেচনা করে তারা হিসাব নিকাশ করেন অর্থাৎ আলোর বেগ পর্যবেক্ষক নির্ভর ধরেন, তাই তাদের ফলাফল এমন আসে। সবশেষে বিজ্ঞানী আইন্সটাইন নিচের স্বীকার্যগুলোতে আসেন।
প্রথম স্বীকার্য: পরস্পর সাপেক্ষে সুষম গতিসম্পন্ন সকল কাঠামোতে (জড় কাঠামোতে) পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র গুলো অভিন্ন।
দ্বিতীয় স্বীকার্য: আলোর বেগ শুন্যস্থানের মধ্যে সর্বত্র, সব অবস্থায় আর সকল কাঠামোতে একই থাকবে। এই বেগ উৎস বা পর্যবেক্ষকের উপর নির্ভরশীল নয়।
গ্যালিলিয়ান রূপান্তরের ভুল থেকেই আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্ম। এটার সংশোধন করতে আর আইন্সটাইনের স্বীকার্য ব্যবহার করে লরেণ্টজ রূপান্তর আসে। তার আগে চল জেনে নেই রূপান্তরটা কী? আর তারপর গ্যালিলিয়ান রূপান্তরটা একটু বিস্তারিত দেখবো।

1 comment:

  1. অসাধারণ ভাবে কনসেপ্ট টা লেখা

    ReplyDelete

Thanks